শুক্রবার ● ১২ জুন ২০২০
প্রথম পাতা » উপকুল » কার্তিকের কান্নার আওয়াজ কতদূর পৌঁছাবে?
কার্তিকের কান্নার আওয়াজ কতদূর পৌঁছাবে?
রফিকুল ইসলাম মন্টু, উপকূল ঘুরে:
ছায়া সুনিবিড় হাজতখালী গ্রামের ঐখানে তার বাড়ি ছিল। দিনমজুর বাবার সারাজীবনের জমানো অর্থ আর নিজের শ্রমে গড়ে উঠেছিল সে দালান বাড়ি। মাত্র একমাস ঘরে বসবাস করতে পেরেছেন। গুছিয়ে নিয়েছিলেন সবকিছু। বুড়ো বাবা-মা, বউ, ছেলেপুলে, সকলেই ছিল একসঙ্গে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রলয়ে প্রবল স্রোতের তোড়ে ভেসে গেল সব। বাঁধ ভাঙা পানির স্রোত হাজতখালীর খালে বাড়িয়ে তুলেছিল ভাঙন। আর সেই ভাঙনে আম্পানের পরের দিন ভোরে চোখের সামনেই আছড়ে পড়লো বাড়িটি।
কার্তিক এখন নিঃস্ব। তার বসত হয়েছে হাজতখালী বাঁধের ঝুপড়ি ঘরে। শহুরে লোকজন আর ক্যামেরা ফ্ল্যাশ লাইটের আলোর ঝলকানি কার্তিকের কান্না বাড়িয়ে দেয়। কাঁদছিলেন তার মা উষারাণী, বউ সুষমারাণী। বাঁধের ওপরে ঝুপড়ি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বার বার হাত তুলে দেখাচ্ছিলেন বাড়ির স্থানটি। যেখানে তার বাড়ি ছিল, সেখানে এখন অন্তত ৩০ হাত পানি। জোয়ারের পানিতে ভেসে যায় সবকিছু। আম্পানের পরের সকালে বাড়ির মালামাল গোছাতে গিয়ে স্রোতের তোড়ে নিজেরাই পড়েছিলেন ঝুঁকিতে। শেষে নিজেরা প্রাণে বাঁচলেও ঘরখানা পড়ে গেল দুমড়ে মুচড়ে।তার পুরো নাম কার্তিক মন্ডল। বাবা খোকন মন্ডল। বাড়িটা খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের হাজতখালী গ্রামে। কার্তিক একা নন, গোটা হাজতখালী গ্রামটাই উঠে এসেছে বেড়িবাঁধের ওপরে। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। যে যেখানে পারছে ঘর বানিয়ে বসতি গড়েছে। কোথায় খাবার পানি, কোথায় টয়লেট, কোথায় রান্না কিংবা থাকার জায়গা, কোথায় গরু-ছাগল রাখার জায়গা! সবকিছুই যেন এলোমেলো। সবার চোখে দু:স্বপ্ন। এগুলো কী বাস্তবে; নাকি স্বপ্নে! মিলাতে পারেন না মানুষগুলো। হাজতখালী স্লুইজগেট থেকে কাশির হাটেখোলা অবধি মাত্র আধা কিলোমিটার বাঁধ ভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছে। এখানেই উঠেছে কয়েকশ’ পরিবার।
কার্তিক মন্ডল জানালেন, মাত্র এক মাস আগে এই বাড়ির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাড়ি করার জন্য দিনমজুর বাবা অনেক কষ্টে ডিপিএস-এ কিছু টাকা জমিয়েছিলেন। সেই টাকাতেই অল্প খরচের দালান করেছিলেন। আম্পান প্রলয়ের মাত্র একমাস আগে উঠেছিলেন সেই ঘরে। কার্তিক শ্রমিকের কাজে ছিলেন খুলনায়। ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল পেয়ে বাড়ি চলে আসেন। কিন্তু এলে কী হবে? শেষ রক্ষা হলো না। যেখানে হাজতখালী গ্রামটাই নেই, সেখানে কার্তিকের ঘর থাকে কী করে! কথা বলার সময় তার আশপাশে ঘুরছিল তার পাঁচ ছেলেমেয়ে- দেব, অরুণ, পুজা, আশা, সুপ্রিয়া। পাশে দাঁড়িয়েছিল বউ সুষমা মন্ডল। বড়দের চোখ ভিজে আছে কষ্টের জলে। ছোটদের চোখে জল না থাকলেও ওদের বুকেও হয়তো বইছে হৃদয়ভাঙা হাহাকার। কেননা, এই প্রাকৃতিক বিপদে বড়দের সঙ্গে ছোটরাও কম ভ‚গছে না।
হাজতখালী গ্রামের ভাঙা স্লুইজ গেট, যেখান থেকে হু হু করে আম্পানের পানি ঢুকেছিল গ্রামে, সেই গেটের কাছেই বেড়িবাঁধের ওপরে কার্তিকের ঘর। কার্তিক স্থান পেয়েছেন বাঁধের উপরের দিকে। কিন্তু ৮৬ বছর বয়সী জগদীশ মন্ডল আর ৭৫ বছর বয়সী অনিতা রাণী দম্পতির ঠাঁই হয়েছে বাঁধের খানিকটা নিচের দিকে। বাঁধের বাইরে, যেখান থেকে জোয়ারের পানি সামান্য দূরে, সেখানেই তাদের এলোমেলো ঘর। পানি বাড়লে এ ঘরখানাও ভাসবে। চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি অনিতা রাণীও। বললেন, সব শেষ হয়ে গেল। এখন কই থাকবো, কী খাবো। পাশে দাঁড়ানো জগদীশ মন্ডলও হাতে থাকা গামছা দিয়ে বার বার চোখ মুছছিলেন।পাশেই ঘরের সঙ্গে লাগানো আরেক ঘর। এ ঘরখানা পরিতোষ মন্ডলের। উদোম শরীরে নির্বাক দাঁড়িয়ে। কিছু বলতে চান তিনিও। তার কাছেও আছে আরেকখানা হৃদয়বিদারক গল্প। পরিতোষ কৃষিকাজ করতেন। নিজের সামান্য জমি আর বর্গা নেওয়া জমিতে বেশ চলে যাচ্ছিল দিনকাল। দু’ছেলেমেয়ে বন্ধনা মন্ডল আর প্রকাশ মন্ডল পড়ালেখা করে উত্তর বেদকাশী কলেজিয়েটে। কিন্তু আম্পান সব এলোমেলো করে দিল। ঝড়ের পরে তাদের বইপত্র নিয়ে এসেছে বটে; কিন্তু সেগুলো সব ভেজা। তপ্ত রোদে ঝুপড়ি ঘরের চালায় সেই ভেজা বইগুলো শুকাচ্ছিল বন্ধনা। পরিতোষ মন্ডল বলেন, মাত্র বছর চারেক আগে প্রায় চার লাখ টাকা খরচে বাড়ি করেছিলেন। ভালোই চলছিলেন। কিন্তু মাত্র এক রাতেই পথে হলো ঠাঁই। আবার কবে ফিরবে স্বাভাবিক জীবন; জানেন না পরিতোষ।
ঘর কিংবা মালামাল বাঁচানো তো দূরের কথা; আম্পানের রাতে এই এলাকার মানুষের জীবন বাঁচানোই ছিল কঠিন। আশ্রয় নেওয়ার মত একমাত্র ভরসা ছিল হাজতখালী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একতলা ভবনটি। কিন্তু সে ভবনটিও প্রবল পানির চাপে অর্ধেকটা ডুবে যায়। এক-দেড়শ’ মানুষ যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারা পরে ছাদে উঠে প্রাণ রক্ষা করেন। মানুষের ভিড়ে এই স্কুল ভবনটিতে যেতে না পেরে অনেকে বাঁধে উঠে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আম্পান প্রলয়ের ২৩দিন পরেও বিদ্যালয় ভবনটির অর্ধেকটা ডুবেছিল পানির নিচে। একদিকে বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ, অন্যদিকে নেই আশ্রয়ের ব্যবস্থা। উত্তর বেদকাশীর কপোতাক্ষ তীর ধরে সব এলাকার অবস্থাই প্রায় একই রকম। স্কুল ভবন ব্যতীত সাইক্লোন শেলটার খুব একটা চোখে পড়েনি। যেখানে বাঁধ নাজুক, সেখানে আশ্রয়কেন্দ্র না থাকলে মানুষজন কতটা অসহায় হয়ে পড়ে; তা কথা না বললে বোঝা যায় না। সেদিনের ভয়াবহতার ছবিটা চোখের সামনে তুলে ধরে রীতা রাণী মন্ডল বলছিলেন, তিনি এবং তার ১২ বছর বয়সী ছেলে দ্বীপ মন্ডল বাঁধের উপরে বাবলা গাছ ধরে বেঁচেছিলেন। রাত দশটার দিকে বাঁধ উপচে গিয়েছিল পানি। রীতা রাণীর স্বামী পরিমল মন্ডল বউ-ছেলেকে বাঁধে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে নিজে চলে যান বাড়িতে। নিজের দালান ঘরেই ছিলেন। ঝড়ে বাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হলেও ঘরখানা দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু শেষ অবধি সেটিও রক্ষা হয়নি। আম্পান প্রলয়ের তিনদিন পরে দালানটি ধ্বসে পড়ে। তার ঘরটি যেখানে ছিল; সেখানে এখন হাজতখালী খালের স্রোতধারা বইছে।
ঘূর্ণিঝড়ের আম্পানের সিগন্যাল পেয়েও ঘর ছাড়েননি হাজতখালী গ্রামের সরোজিনী মন্ডল। বাড়ির সামনে রাস্তায় এসে উঠেছিলেন। পানির তোড় বাড়লে একটি বকুল গাছের ডাল ধরে প্রাণ রক্ষা করেন। স্বামী স্বপন মন্ডল আর ছেলেমেয়ে হৃদয়, গৌরী সেখানেই ছিল রাতভর। একই গ্রামের বাবুলাল সরকারের বউ ঊষারাণী সরকার বাড়িতেই ছিলেন। পরে ভয় বাড়ে। রাত দশটার দিকে গ্রামের একমাত্র আশ্রয়ের স্থান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনে যান। নিচতলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে পানি বাড়তে থাকলে প্রথমে সিঁড়িতে এবং শেষে ভবনের ছাদে আশ্রয় নেন। আম্পানের প্রলয়ের রাতে হাজতখালীর মানুষেরা এক বিভিষীকার অতিক্রম করেছে। গ্রামের মানুষজন প্রাণে রক্ষা পেলেও সম্পদ কিছুই বাঁচেনি।
ভাঙা স্লুইজ গেটের পাশে বেড়িবাঁধের ওপরে দাঁড়িয়ে দেখা যায় পানির নিচে হাজতখালী গ্রাম। দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি বড় গাছ ছাড়া গ্রামের আর কিছুই দেখা যায় না। সবই পানির স্রোতে ভেসে গেছে। স্লুইজ গেট ভেঙে পানি ঢুকে গ্রামের সরু খালটি ভাঙনে অনেক বড় হয়ে গেছে। অথচ এই গ্রামের মানুষদের সব ছিল। ধান ক্ষেত, সবজি ক্ষেত, পুকুর, ফলের গাছ, সাজানো গোছানো বাড়িঘর, সবই ছিল। খালের ধার দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছিল সরু রাস্তা। এখন সে সবের কোন নিশানা খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। মানুষগুলো বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে শুধু হাহাকার করছেন। আর ভাবছেন কীভাবে আবার শুরু করবেন।
টুম্পারাণী মন্ডল গ্রামের দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন, ওই যে দেখছেন তরঙ্গময়, ওখানেই ছিল আমার সবজির বাগান। বেশ আনাজপাতি হতো। প্রায় বাড়িতেই ছিল বাগান। অনেকে তো সপ্তাহে চার হাজার টাকা থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত আনাজপাতি বিক্রি করতো। সে টাকা সংসার চালাতে সাহায্য করতো। কিন্তু সেসব এক নিমিষে হারিয়ে গেল। কবে যে বাড়ি ফিরতে পারবো, তারও কোন হিসেব নেই। অনেকে আম্পানের এই প্রলয়কে আইলার চেয়েও ভয়াবহ বলে আখ্যা দিলেন। বললেন, আইলার পরে পানি নেমে গিয়েছিল, কিন্তু আম্পানে যে পানি রেখে গেল গ্রামজুড়ে; তা তো আর সরছে না। নদীতে মাছ নেই, মাঠে ঘাটে কাজ নেই, চলবে কীভাবে? কার্তিক, অনিতা, জগদীশ, পরিতোষদের কান্নার আওয়াজই বা কতদূর পৌঁছাবে? এইসব প্রশ্নের জবাব মিলে না।