শনিবার ● ৬ জুন ২০২০
প্রথম পাতা » উপকুল » উঠোনে উঠে এসেছে কপোতাক্ষ নদ!
উঠোনে উঠে এসেছে কপোতাক্ষ নদ!
রফিকুল ইসলাম মন্টু, উপকূল ঘুরে :
‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে! সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।’ কবির সেই বিখ্যাত কবিতাখানির মতোই লেবুবুনিয়ার মানুষের মনে সতত কপোতাক্ষ নদ। তবে কাব্যে নয়, প্রলয়ে। কপোতাক্ষ নদ যেন মহাপ্রলয় নিয়ে উঠে এসেছে বাড়ির উঠোনে। পুকুর, ডোবা, খোলা মাঠ, চলার পথ, পানির কল— সব ডুবিয়ে নদ উঁকি দিয়েছে ঘরের চৌকাঠে। থই থই জলরাশি ঘরের চারিদিকে। চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের বাইরে বেরোলে এতটুকু শুকনো জায়গা পাওয়া মুসকিল। হাঁটু কাদাপানি পেরিয়ে যেতে হয় এক ঘর থেকে অন্য ঘরে। আর বাইরে কোথাও যেতে হলে একমাত্র ভরসা নৌকা।ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকোর গলুই ধাক্কা খেল লেবুবুনিয়া গ্রামের আবদুল জলিল গাজীর উঠোনে। ঠিক নদী পেরিয়েই উঠোন। তবে সবকিছু পানিতে ডুবে থাকায় বোঝার উপায় নেই কোথায় কী! উঠোন জুড়ে শেকড়শুদ্ধ রেইনট্রি গাছ উপড়ে পড়ে আছে। শূন্য ভিটের ওপর তিনটি ছাগল কতগুলো পাতা চিবোচ্ছে। খাবারের অভাবে তারাও যেন কঙ্কালসার। খানিক দূরে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে জলিল গাজীর স্ত্রী হাকিমা বেগম। প্যান্ট পরা, ক্যামেরাওয়ালা লোকদের এ গ্রামের আসার উদ্দেশ্য তখনও বুঝতে পারেননি জলিল গাজী। তার কথা জড়িয়ে যায়; হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। তিনি প্যালাইসিস রোগী। এগিয়ে আসেন মাওলাবক্স গাজীর ছেলে আজগর আলী গাজী। জানা শোনা মানুষ। উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বলতে থাকেন একের পর এক। না, তেমন কোনো সাহায্য সহযোগিতা এখানে এখনও আসেনি। এটা পশ্চিম উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের ঘূর্ণিঝড় আম্পান বিধ্বস্ত লেবুবুনিয়ার গল্প। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতের পর লেবুবুনিয়া গ্রামটি আলোচনায় আসে; ঠিক যেমন ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পরে বিশ্বব্যাপী আলোচনায় উঠে এসেছিল গাবুরা ইউনিয়নের নাম। কিন্তু আালোচনার কেন্দ্রে নাম উঠে এলে কী হবে! অবস্থা তো আর বদলায় না। বরং এইসব ঝুঁকির স্থানগুলো এক সময় কিছু মানুষের পুঁজি হয়ে দাঁড়ায়। আম্পানের আঘাতের পর লেবুবুনিয়ার নাম আলোচনায় এলেও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। উল্টো অবনতি ঘটেছে। সরেজমিনে ঘুরে চোখে পড়েছে বিপন্নতার অন্য এক রূপ।
প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আম্পান প্রলয় তছনছ করে দিয়ে গেছে লেবুবুনিয়ার ভেতর বাহির। এটা এখন আর মূল ভূখন্ডের কোনো গ্রাম নয়; পরিণত হয়েছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। দিনে রাতে দু’বার জোয়ারের পানিতে ভাসে এ গ্রাম। ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল পেয়েও গ্রামবাসী কোথাও আশ্রয়ে যেতে পারেনি; কেননা গ্রামে নেই আশ্রয়কেন্দ্র। পানি পেরিয়ে দূরের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগও থাকে না। ১৯৮৮ সালের ঝড়ের ওলটপালটের মধ্যদিয়ে অন্য স্থান থেকে কতগুলো পরিবার এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। সে বছরের দুর্যোগ এদের সব কেড়ে নিয়েছিল। হারিয়েছিল বাড়িঘর, এমনকি ভিটে। দুর্যোগের বিপদ থেকে এখানে এলেও বিপদ পিছু ছাড়ে না এদের। ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালের আইলা, ২০১৯ সালের ফণী, বুলবুল- সবই পিষে গেছে লেবুবুনিয়াকে। এবার আম্পান ভাসিয়ে গেল।গ্রামটির দক্ষিণে কপোতাক্ষের গা ঘেঁসে আবদুল জলিল গাজীর ঘর। তার স্ত্রী হাকিমা বেগম বলছিলেন ১৯৮৮ সালের ঝড়ের পর দূরের গ্রাম থেকে উঁচু স্থান দেখে লেবুবুনিয়া গ্রামে আসেন। সে বহু বছর আগের কথা। কিন্তু এই উঁচু স্থানটিও যে পানিতে ডুবে যাবে; তা ভাবতে পারেননি কেউই। স্বামীর অসুস্থতায় হাকিমা বেগম হারিয়ে ফেলেছেন উচ্ছলতা। সন্তান ধারণ করতে না পারায় তার সে কষ্টটা যেন আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এর ওপর এইসব দুর্যোগ জীবনকেই যেন বিষিয়ে তুলেছে। লুৎফর গাজী (৫০), আজগর গাজী (৪৫), মাওলা গাজী (৭০), রুহুল কুদ্দুস (৪২), আকবর গাজী (৪৫), শহীদুল হক গাজী (৬৫), ফরিদ গাজী (৩৫), করিম গাজী (৭০), ফারুক গাজী (৪২), মোস্তফা গাজী (৬০), এমদাদুল হক (৩৫) সহ এই গ্রামের আরও অনেকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারি এখানকার বিপন্নতার চিত্র।বাসিন্দারা জানালেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পান এদের জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। একে তো করোনার সময়। কোনো কাজকর্ম নেই। গ্রামের প্রায় সকল মানুষই কর্মহীন। এর ওপর এ ধরনের প্রলয়ংকরী দুর্যোগের বিপদের ভার তারা সইতে পারছেন না। এখানকার প্রায় সকল মানুষ নদীতে মাছ ধরে, বনে কাজে যায়। এখন সব কাজই বন্ধ। ফলে আয় রোজগার নেই। ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। ঘরের সামনে পানিতে ডুবে থাকা আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে সূর্য বিবি (৫৫) বলছিলেন, ঘরের চারিদিকে পানি। বড় জোয়ার এলে ঘরেও উঠে যায় পানি। আমরা কোথাও যেতে পারি না। ১৯৮৮ সাল থেকে একের পর এক দুর্যোগের বিপদে আছি। আমাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। সূর্য বিবি’র কথার সূত্র ধরে নছিরন বিবি (৪০) যোগ করেন, নদীর কাছ থেকে দূরে উঁচু জায়গা দেখে ঘর করেছিলাম। এখানেও রক্ষা পেলাম না।
কথা বলতে বলতে আজগর আলী গাজীর ঘরের সামনে ভিড়ল একটি ডিঙি। কিছু মালামাল, পানির ড্রাম, মাছধরার উপকরণ, কিছু সদায়পাতি এবং কয়েকজন মানুষ নামল। এখন এটাই তাদের যাতায়াতের ভরসা। এক সময় লবণ পানি ছিল না। রাস্তাঘাট ছিল। চলাচলে, যাতায়াতে বেশ শান্তি ছিল। সেই শান্তি কোথায় গেল, কথার মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন হালিমা বেগম। পাশে এক হাঁটু কাদার ভেতরে দাঁড়ানো জাকিয়া বেগম বলেন, আমাগো দিকে কেউ তাকায় না। আম্পানের পর আমরা তেমন কিছুই পাইনি। জরুরি সহায়তা হিসেবে দিয়েছে সামান্য চাল। বেঁচে থাকতে হলে তো আরও অনেক কিছু লাগে!
জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলে জনপদ বিচ্ছিন্ন হওয়ার দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লেবুবুনিয়া গ্রামটি। ২০০৯ সালে আইলার প্রলয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল এ গ্রামের। এরপর ২০১৯ সালের বুলবুল আর ফণীতেও কম ক্ষতি হয়নি। তবে আইলার পরেও এ গ্রামটি বেশ ভালোই ছিল।আমার ২০১৪ সালের ফটোফোল্ডারে গাবুরার ছবিতে যে শিশু মুক্তাদিরকে দোলনায় দোল খেতে দেখেছিলাম, সে এখন গ্রামের কাদাপানি মাড়িয়ে হাঁটছে। পড়ছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। দুর্যোগের বিপদ প্রজন্মের ওপর ফেলছে বাড়তি চাপ। শিশুদের লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। পানি বাড়লে স্কুলে যাওয়া বন্ধ থাকছে। আছে পানিবাহিত রোগবালাইয়ের প্রকোপ।কিন্তু মুক্তাদিরের মত শিশুদের তো সুষ্ঠু, সুন্দর পরিবেশেই বড় হওয়ার অধিকার রয়েছে। সে অধিকার কী শিশু অধিকার সনদের ধারায়ই ব্র্যাকেটবন্দি থাকবে! প্রশ্ন নিজের কাছেই।
গাবুরার আরেক গ্রাম পারশেমারী-টেকেরহাট। ছড়ানো ছিটানো ঘর। পাশে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ। ভর দুপুরে তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন। তবুও কিছু মানুষের কাজের তাড়া। ভাঙা বেড়িবাঁধের পাশের ছোট্ট ঘরের ভেতর থেকে মাথা নিচু করে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন মোশাররফ হোসেন। ঘূর্ণিঝড় আম্পান তার ক্ষতি করেছে ব্যাপক। ঘরের মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। জানালেন, আম্পানের সিগন্যাল পেয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিলেন।আম্পানের পর ঘরের আশপাশে পানি থাকায় ঘরে উঠতে সময় লেগেছে। আম্পানের সিগন্যাল পাওয়ার পরই মোশাররফ হোসেনের মনে পড়েছিল আইলার প্রলয়ে ছোট ভাই আসাদুল হককে হারানোর কথা। আইলায় প্রাণ হারানো ১১ জনের তালিকায় নাম রয়েছে আসাদুলের। ছোট ভাইয়ের কথা মনে করে আম্পানের সিগন্যালে কেউই ঘরে থাকেননি। জীবন বাঁচাতে ছুটেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। নাজুক বাঁধ তাদের আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছিল। এ এলাকায় বাঁধের একাংশ ধসে গিয়েছিল।
শুধু পারশেমারী আর লেবুবুনিয়া নয়, গাবুরা ইউনিয়নের অনেক স্থানে বেড়িবাঁধ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। কেন এ অবস্থা, জানতে চাইলে পরিষদ চেয়ারম্যান জি এম মাসুদুল আলম বলেন, ইউনিয়নের চারপাশ ঘিরে আছে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। ষাটের দশকে এ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। সিডর, আইলাসহ বিভিন্ন সময়ের ঘূর্ণিঝড়ের এ বাঁধ তছনছ হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও বাঁধ মজবুত করতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। এরফলে বাঁধ ক্রমেই নাজুক হয়েছে। আম্পানের ধাক্কায় ইউনিয়নের পাঁচ স্থানে বাঁধ ধ্বসে পানি ঢুকেছে। বহু মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। স্থানীয় মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে রিংবেড়ি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন প্রয়োজন শক্ত করে বাঁধ দেওয়া।
এই নাজুক বেড়িবাঁধের ফলে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে জনজীবনে, জানতে চাইলে মাসুদুল আলম বলেন, প্রভাব তো স্পষ্ট। বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। জমি কমে গেছে। বিগত ২৫ বছরে প্রায় ২ হাজার বিঘা জমি পানির তলায় চলে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে চিংড়ির ঘেরের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। কৃষি জমির মালিকেরা ক্ষতির মুখে পড়েছে। আইলার পর থেকে এই এলাকা থেকে অন্তত দুই হাজার মানুষ ভিটে ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এদের মধ্যে অল্প সংখ্যক ফিরে এলেও অধিকাংশই আর ফিরতে পারেনি।
গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাব এসিসট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার সাজ্জাদুল হক। গাবুরার বাঁধ প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, শক্ত করে বাঁধ দেওয়ার জন্য যে বরাদ্দ প্রয়োজন, তা পাওয়া যায় না। বার্ষিক বরাদ্দ হিসেবে যেটা পাওয়া যায়, তা ঝুঁকি সামলানোর কাজে ব্যয় হয়। গাবুরাসহ এই এলাকার বাঁধগুলো মজবুত করতে হলে ব্লক ফেলে শক্ত করে বাঁধ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য প্রয়োজন হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ।
কপোতাক্ষ নদে ভাটার টান। লেবুবুনিয়া গ্রামটি ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। চারিদিকে জলরাশির মাঝে একখণ্ড ছোট্ট গ্রাম। কিছুক্ষণ আগে জোয়ারের সময় ডুবে থাকা পানির কল, পায়খানার রিং স্লাব, ভাঙন প্রতিরোধী বাঁশের পাইলিং, উঠোন, চলার পথ, কিছুটা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। বেলা গড়িয়ে পড়েছে; তবুও কারো ঘরে তখনও দুপুরের খাওয়া হয়নি। সকলেই জোয়ারের পানি কমে যাওয়ার অপেক্ষায়। আর আমাদের অপেক্ষা ঘাটে ফেরার। উজানে ঢেউয়ের বিপরীতে চলে জহিরুল ইসলামের ছোট্ট ইঞ্জিন ডিঙ্গি। কপোতাক্ষ থেকে খোলপেটুয়া। সুন্দরবনের গা ঘেঁসে ট্রলারের গন্তব্য নীলডুমুর ঘাট।