শিরোনাম:
ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

Dip News24.com
বৃহস্পতিবার ● ৪ জুন ২০২০
প্রথম পাতা » উপকুল » পানিবন্দি প্রতাপনগর কাঁদছে
প্রথম পাতা » উপকুল » পানিবন্দি প্রতাপনগর কাঁদছে
৬০৩ বার পঠিত
বৃহস্পতিবার ● ৪ জুন ২০২০
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

পানিবন্দি প্রতাপনগর কাঁদছে

রফিকুল মন্টু উপকূল ঘুরে :
---
ভর দুপুরে তপ্ত রোদে ঘরের কাজে ব্যস্ত আমিরন বেগম। বয়সের ভারে ন্যূয়ে পড়েছেন। সত্তর ছুঁয়েছেন; তবু কাজে বিরাম নেই। কতবার যে ঘরবাড়ি ভেসেছে বানের পানিতে! হিসেব নেই। এবার প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আম্পান তাকে উঠিয়েছে ছেলের নৌকোয়। যে নৌকো সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়; সে নৌকোই এখন তার ঘর। কপোতাক্ষের বুকে ভাসমান কালো দীর্ঘদেহী ডিঙি নৌকা খানির মাঝ বরাবর ত্রিপল দিয়ে বানানো হয়েছে ছই। নৌকোর পেছনে চাটাই পেঁচিয়ে তৈরি হয়েছে লেট্রিন। এই ছইয়ের নিচে থাকেন সাত জন। এদেরই একজন আমিরন। দুপুরের খাবার আয়োজনের ব্যস্ততায় তার সঙ্গে দেখা।
এটা পশ্চিম উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাহুনিয়ার গল্প। খুলনা থেকে কয়রা কিংবা গাবুরার চৌদ্দরশির পথে যারা নৌপথে যাতায়াত করেন, ‘কুড়িকাহুনিয়া’ শব্দটি তাদের চোখ এড়নোর কথা নয়। লঞ্চঘাটে নতুন টার্মিনালে বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে স্থানের নামটি। কিন্তু টার্মিনালে লেখা নাম দেখে কুড়িকাহুনিয়ার ভেতরকার অবস্থা বোঝার কোন উপায় নেই। প্রতাপনগর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডটি গঠিত কুড়িকাহুনিয়া আর শ্রীপুর গ্রাম নিয়ে। সাধারণত এখানে শহুরে লোকজনের পা পড়ে না। এ এলাকার সংসদ সদস্য, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকেও স্থানীয় বাসিন্দারা খুব একটা দেখেন না। অনেকে তো এমপি’র নামই ঠিক করে গুছিয়ে বলতে পারলেন না। জীবনে তাকে কখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি এ এলাকার বহু মানুষের। কেউ কেউ আবার বলছিলেন ছবি দেখেছি; কিন্তু মানুষটা কেমনে কথা কয়, কেমনে হাঁটে, কতটুকু লম্বা, কী পোষাক পড়ে; তা দেখি নাই। এলাকার আম্পান বিপন্নতার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে এইসব অভিযোগই করলেন বাসিন্দারা।

কুড়িকাহুনিয়ায় গিয়ে কারোই দৃষ্টি এড়াবে না আমিরনের নৌকার ঘর। বাইরের অপরিচিত লোক দেখে তিনি একটু হতবাকই হলেন। ছবি তুলতে গেলে বার বার মাথার কাপড়টা টেনে কপালের দিকে নামাচ্ছিলেন। পরে বুঝলেন ছবি তোলার উদ্দেশ্য। খুলে বললেন সব। আম্পানের রাতের কথা বলতে গিয়ে আমিরন বলছিলেন, আছরের নামাজের পর, ইফতারের আগে, সকলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যান আশ্রয়ের সন্ধানে। সে সন্ধ্যায় কোথায়, কী দিয়ে ইফতার করেছিলেন; মনে নেই আমিরনের। রাত তো কেটে গেল ঝড়ের মাঝেই। সকালে বাড়িতে এসে দেখেন ১৪টিন ধান উঠোনে। ঘরের মালামাল, হাঁস মুরগি, সব ভেসে গেছে। পানিতে ডুবন্ত। অন্য চেহারার এক বাড়ি। যে বাড়িতে আমিরন ছিলেন; যে উঠোন-ঘর তার খুব চেনা; এক রাতে নিজের বাড়িটাই যেন অচেনা বাড়িতে পরিণত হলো। এ বাড়িটা যেন তার সে বাড়িটা নয়। কোথায় থাকবেন আমিরন, তার স্বামী ওমর আলী সরদার, তার ছেলেরা! সকলেই অসহায়। অবশেষে দুই ছেলের নৌকাই হলো ঘর। শুধু আমিরন একা নন; এমন ঘর ভেসেছে আরও বহুজনের। এই এলাকায় অনেকগুলো পরিবার উঠেছে নৌকায়। নৌকা খানাই যেন এই বিপদে তাদের সঙ্গী হলো।
প্রাকৃতিক বিপদে বার বার ক্ষতির মুখে পড়লেও আমিরন নিকট স্বজন কাউকে হারাননি; কিন্তু এই আমিরনের বিপদ দেখে আমার মনে পড়ল কয়রার আরেক আমিরুনের কথা। ১৯৮৮ সালের দুর্যোগে তিনি তার স্বামীকে হারিয়ে জীবনের ছন্দই হারিয়ে ফেলেছিলেন। এক পর্যায়ে ছেলে এবং মেয়েরাও তার কাছ থেকে সরে যায়। আমিরুন একা হয়ে যান। কয়রার আমিরুন আর কুড়িকাহুনিয়ার আমিরনেরা যেন একই কাতারের মানুষ। দুর্যোগ এদের জীবন তছনছ করে দেয়। এই জনপদে এমন নারী আছেন হাজারো। এদের গল্প যেন ফুরোয় না।

তালতলা বাজার। প্রতাপনগর ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় স্থানগুলোর একটি। আশাশুনি উপজেলা সদর থেকে পিচঢালা পথ প্রতাপনগরের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে পৌঁছেছে তালতলা বাজারে। বাজারে পৌঁছাতেই হঠাৎ কানে আসে মাইকের আওয়াজ। কান ঘেঁসে চলে যায় ঘোষণা। বলা হয়- ‘আম্পানের পর কুড়িকাহুনিয়ায় আমরা যে বাঁধ দিয়েছিলাম; তা ভেঙে গেছে। আজ ভাটার সময় বাঁধ বাধা হবে। পুরুষ মানুষ কেউ বাড়িতে থাকবে না। সবাই চলে আসবে কাজে।’ মাইকিং করছিলেন বাজারের ব্যবসায়ী আহসান উল্লাহ। এই ঘোষণার জন্য আইয়ূব আলী সব সময়ই তার মাইক ব্যবহার করতে দেন। কপোতাক্ষে ভাটার টান পড়তে না পড়তেই ঘোষণার ফল পাওয়া গেল। বাজারের সব দোকান বন্ধ। বাঁশ ফেলে চলার পথ আটকে দেওয়া হয়েছে। এ যেন এক ভিন্ন রকমের ধর্মঘট। সব কাজ ফেলে মানুষগুলো ছুটছেন কুড়িকাহুনিয়া আর হরিশখালীর দিকে। বাঁধে জোড়া লাগাতে না পারলে যে রক্ষা নেই।
ঘরের চারিদিকে পানি থই থই করছে। কপোতাক্ষ সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আম্পানের রাতে এক প্রলয় এসেছিল। কেউ কেউ এটাকে আইলার চেয়েও বড় প্রলয় বলে থাকেন। তালতলা বাজারের পিচঢালা পথ পর্যন্ত গেলে কারো বোঝার উপায় নেই এখানে কোন প্রলয় ঘটেছে। আমিও বুঝিনি। মানুষগুলো পথ দেখিয়ে দিলেন, ডানে, বামে, সোজা, যেদিকেই যাওয়া হোক না কেন; পানি আর পানি। প্রতাপনগর ইউনিয়ন ঘিরে রাখা দুই নদী কপোতাক্ষ আর খোলপেটুয়া যেন এলাকার মানুষের প্রতি একটু রাগই করে ফেলেছে। তাই মানুষগুলোকে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে। হয়তো মানুষের সঙ্গেই সুর মিলিয়ে নদীগুলো বলছে, তোমরা আমাদের তীর কেন শক্ত করে বাঁধো না! তোমরা তোড়াতালির বাঁধ দিয়ে কেন আমাদের বিপদে ফেল! আলাপে আলাপে মানুষগুলোর কথা থেকেই যেন নদীগুলোর আর্তি বেরিয়ে আসে।
কুড়িকাহুনিয়ায় তপ্ত রোদের মাঝে মানুষদের সঙ্গে কথা বলার জন্য একটু স্থান পাওয়া যাচ্ছিল না। বাঁধের ধারে দু’একটা গাছ হয়তো ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বটে; কিন্তু বসার স্থান নেই। দোকানের ছোট্ট বেঞ্চিতে একটু বসার স্থান হলেও সকলে রোদের মাঝে দাঁড়িয়েই দিচ্ছিলেন নানান তথ্য। অভিযোগ আর ক্ষোভের অন্ত নেই এলাকার মানুষের। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের মাত্র দু’মাস আগে এখানে বাঁধ ধ্বসে গিয়েছিল। সে বাঁধ জোড়া লাগানো হয়েছে বটে; কিন্তু সেই জোড়াতালির সংস্কার। এইসব কাজের বিষয়ে কারো কোন কিছু বলার সুযোগ নেই। কারও কথাই বাস্তবায়নকারীরা শোনে না। তা হলে তাদের আপীল জানানোর জায়গা কোথায়? এই যে আম্পানে এত ক্ষতি হয়ে গেল; এখনও মানুষগুলো পানির মধ্যেই হাবুডুবু খাচ্ছে; কে শুনবে তাদের কথা! কে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে! এখানে এখন পর্যন্ত এদের কথাগুলো শুনতে আসেনি কেউ। তাদের এখন কী সহায়তা দরকার; তা শোনার প্রয়োজন কেউ মনে করছেন না।

কুড়িকাহুনিয়া আর শ্রীপুরের গা জুড়ে একেবারেই টাটকা; তরতাজা আম্পানের ক্ষত। রুহুল আমীর গাজী (৭৫) ভেঙে যাওয়া বাঁধের ধারে বসে নিজের জমির দিকে তাকিয়েছিলেন। এই নদীর বিক্ষুব্ধ অবস্থা; এই জলোচ্ছ্বাস; যেন কিছুই করার নেই তার। প্রতাপনগর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কুড়িকাহুনিয়া ও শ্রীপুরের প্রায় আড়াই কিলোমিটার বাঁধ ধ্বসে গেছে আম্পানের ধাক্কায়। স্থানীয় বাসিন্দারা রিং বাঁধ দিয়ে বাড়িঘর বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। এত চেষ্টার পর তৈরি করা রিং বাঁধ হঠাৎই জোয়ারের চাপে ধ্বসে গেছে। বাঁধ ধ্বসে যাচ্ছে; আবার জোড়া লাগাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এই একটি ওয়ার্ডে প্রায় ১৫ হাজার লোকের বসবাস। তারা কোথায় যাবে!

প্রবল বাতাসে ঢেউ জাগে কপোতাক্ষের বুকে। সকাল দুপুর বিকেল হয়। সন্ধ্যা নামে; আবার ভোরের আলোয় আলোকিত হয় কুড়িকাহুনিয়া। সকালে-রাতে হুইসল বাজিয়ে লঞ্চ ভেড়ে ঘাটে। সব নিয়মই ঠিক থাকে; কিন্তু এখানকার মানুষের জীবন বিপন্নতার রাহুমুক্ত হয় না। ঘরহারা মানুষগুলো সব হারিয়ে যেন অন্ধকারেই ডুবে আছে। ঘেরের মালিক, কৃষক, মাছের ব্যবসায়ী, মজুর কিংবা শ্রমিক, সকলকেই আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। ব্যবসায়ী আবুল হাসান, শিক্ষক আবদুল কাদের, কৃষক রুহুল আমীর গাজী, মজুর আমজাদ হোসেন সরদার, ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক, ব্যবসায়ী আবদুল খালেক এবং আরও অনেক জনের নাম। সকলেই যেন এক কাতারে মিশে গেছে। আম্পান এদের সর্বস্ব নিয়েছে। প্রতাপনগর ইউনিয়নের এই তিন নম্বর ওয়ার্ডের সকলের কথা এখানে না লিখলেও সকলের অবস্থা প্রায় একই রকম। গ্রামের ভেতরের ইট বিছানো রাস্তার ইট ভেসে গেছে। বাড়িঘরের উঠোন, দরজা, খেলার মাঠ, কৃষি ক্ষেত, কোন কিছুর পার্থক্য বোঝার কোন উপায় নেই। সবকিছ্ইু তিনচার ফুট পানির তলায় ডুবে আছে। ঘর থেকে রাস্তায় আসতে কেউ বাঁশের সাঁকো বানিয়েছেন, কারো ভরসা নৌকো। আবার অনেকে কোন ব্যবস্থা না করে পানির ভেতর দিয়েই চলাচল করছেন। প্রতাপনগরের চারিদিকে ক্ষতবিক্ষত এক বিপন্ন রূপ। পানিবন্দি প্রতাপনগর কাঁদছে।





উপকুল এর আরও খবর

চরফ্যাশন মুজিবনগর ইউনিয়নে মহান বিজয় দিবস উদযাপন চরফ্যাশন মুজিবনগর ইউনিয়নে মহান বিজয় দিবস উদযাপন
চরফ্যাশন কারামাতিয়া কামিল মাদ্রাসার বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ ও পুরস্কার বিতরণী চরফ্যাশন কারামাতিয়া কামিল মাদ্রাসার বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ ও পুরস্কার বিতরণী
চরফ্যাশনে বেগম রোকেয়া দিবসে জয়িতাদের সংবর্ধনা চরফ্যাশনে বেগম রোকেয়া দিবসে জয়িতাদের সংবর্ধনা
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কোস্ট ফাউন্ডেশনের গাছের চারা বিতরণ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কোস্ট ফাউন্ডেশনের গাছের চারা বিতরণ
চরফ্যাশনে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত চরফ্যাশনে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত
তজুমদ্দিনে উপজেলা বিএনপির দাবী “দলের সুনাম ক্ষুন্ন করার জন্য মিডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে” তজুমদ্দিনে উপজেলা বিএনপির দাবী “দলের সুনাম ক্ষুন্ন করার জন্য মিডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে”
চরফ্যাশনে হামলা-ভাঙচুর মামলার আসামিরা প্রকাশ্যে ধরছে না পুলিশ চরফ্যাশনে হামলা-ভাঙচুর মামলার আসামিরা প্রকাশ্যে ধরছে না পুলিশ
চরফ্যাশন বাজার চাল আড়ৎদার ব্যবসায়ী সমিতির কমিটি গঠন চরফ্যাশন বাজার চাল আড়ৎদার ব্যবসায়ী সমিতির কমিটি গঠন
চরফ্যাশনে বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ চরফ্যাশনে বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ
তজুমদ্দিনে আড়ালিয়া মাদ্রাসায় বিশৃংখলার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন। তজুমদ্দিনে আড়ালিয়া মাদ্রাসায় বিশৃংখলার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন।

আর্কাইভ