শনিবার ● ১৩ জুন ২০২০
প্রথম পাতা » উপকুল » ঘূর্ণিঝড় আম্পান যেখানে লবণ পানির সাথেই মানুষের বসবাস
ঘূর্ণিঝড় আম্পান যেখানে লবণ পানির সাথেই মানুষের বসবাস
রফিকুল ইসলাম মন্টু, উপকূল ঘুরে :
মাকসুদা বেগমের রান্নাঘর পানির তলায়। উঁচু করে চুলো বানিয়ে সারছেন রান্নার কাজ। অতিকষ্টে রান্না করতে পারেন মাত্র একবেলা। জ্বালানির অভাবে যেদিন সে সুযোগটুকুও থাকে না, সেদিনের খাবার চিড়া-মুড়ি। ঘরের সামনে পানির কল ডুবে আছে।
পানি কিছুটা কমে গেলে কলের পানিতেই সারতে হয় গোসলসহ অন্যান্য কাজ। ঘরের ভেতরে খাটের ওপরে রেখেছেন আরেকটি খাট। তার ওপরে কোনোমতে রাত পার করছেন। সারাদিন কাটছে পানিতেই; শুধু ঘুমানোর সময়টুকু শুকনোয়। খাট থেকে নামার পর থেকে সবখানেই পানি আর পানি।
এ চিত্র খুলনা বিভাগীয় সদর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে কয়রা উপজেলার গোবরা গ্রামের। ২০ মে পশ্চিম উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আম্পান এ এলাকার মানুষদের লবণ পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে। প্রলয়ের পর প্রায় ২২ দিন কেটে গেলেও স্বাভাবিক হয়নি জীবন। গ্রামগঞ্জ, বাড়িঘর, স্কুল, ইট বিছানো রাস্তা সবকিছু পানির তলায়। দিনে দু’বার জোয়ারের পানিতে ভাসছে জনপদ।
গোবরা ঘাটাখালীর যে স্থানটিতে বাঁধ ধসে পানি ঢুকেছে, তার খুব কাছেই বাঁধের পাশে মাকসুদা বেগমের ঘর। স্বামী আবদুল গনি সরদার দিন এনে দিন খাওয়া মজুর। কোনোমতে চলছে পাঁচজনের সংসার। ঘূর্ণিঝড় আম্পান এ পরিবারে সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বাঁধের ধারে আরও অনেক বাড়িঘর। সবগুলো পানির তলায়। কাছেই পানির ভেতরে কাজ করছিলেন আইয়ূব আলীর স্ত্রী নূরজাহান বেগম। তিনি বললেন, লবণ পানির মধ্যে থাকি। কোথায় যাব? যাওয়ার তো কোনো জায়গা নেই। থাকার ঘর ডুবে আছে, চলার পথ ডুবে আছে, টয়লেট ডুবে আছে। পানি আনতে হয় দূরের কল থেকে। মানুষের খাদ্যের পাশাপাশি গবাদিপশুর খাদ্যেরও অভাব দেখা দিয়েছে।
কয়রার মদিনাবাদ লঞ্চঘাট হয়ে গোবরা গ্রামের পথে। রাস্তার দু’ধারে থই থই পানি। একপাশে নদী। অন্য পাশে ডুবে থাকা বাড়িঘর, ফসলি মাঠ, চিংড়ির ঘের। অথচ আম্পানের আগে এসব এলাকার ছবি ছিল অন্য রকম। মানুষের জীবন ছিল স্বাভাবিক। নদীর ধারের পিচঢালা পথ মিশেছে গোবরা গ্রামের ইট বিছানো পথে। সড়কের দু’ধারে পানির নিচে ডুবন্ত বাড়িঘর। ডুবে থাকা চলার পথের ওপরে বাঁশের সাঁকো দেওয়া হয়েছে। এটাই এখন চলার পথ। সাঁকো দিয়ে চলাচল করছে আর ঘরের ভেতরে মাচা পেতে বসবাস করছে কোনোমতে। যাদের ঘরে থাকার সুযোগ নেই, তারা কেউ চলে গেছে আশ্রয়কেন্দ্রে, কেউবা বাঁধের ঢালে।
গোবরা গ্রামের ইট বিছানো পথ চলে গেছে নদী তীরের বাঁধের কাছে। সড়কের কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি। সড়কের দু’ধারের বাড়িঘরগুলোও পানির নিচে। রাস্তার ওপরেই গোবরা বাজার। দোকানপাট বন্ধ। দু’একটি দোকান অতি প্রয়োজনীয় সবজি নিয়ে বসেছে পানির ওপরে টং পেতে। কিছু দোকানে বেচাকেনার বদলে পরিবারের বসবাস। এমনই একজন ইস্রাফিল হোসেন সরদার। কখনো মজুর খাটা, কখনো মাছের ব্যবসা, এভাইে চলছিল জীবন। কিন্তু এখন সেই টানাটানির জীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়। ডুবে যাওয়া ঘরে থাকতে না পেরে উঠেছেন গোবরা বাজারের ছোট্ট দোকানে। মেঝেতে পাতা চৌকিটাও ডুবে যাচ্ছে পানিতে। তারই ওপরে বসবাস। স্ত্রী আকলিমা বেগম পাশে পাতানো চুলোয় রান্না করছিলেন। পানিতে ডুবন্ত ঘরের পাশে একটি ডিঙি নৌকা। ব্যবসার কাজে ভাড়া এনেছেন। রাতের জোয়ারে ঘরে পানি উঠলে এ নৌকাই হয় ইস্রাফিলের ঘুমানোর স্থান।কোমর সমান পানির ভেতর দিয়ে এগোই গোবরা ঘাটাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে। বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে পানি কিছুটা কম থাকলেও মাঠে অনেক পানি। বিদ্যালয়ের দোতলা ভবনটিতে ১৯টি পরিবারের ঠাঁই হয়েছে আম্পানের রাত থেকে। এদের মধ্যে নিচতলায় আশ্রয় নেওয়া চারটি পরিবার পানির ভেতরেই থাকছে। জোয়ারের পানি বাড়লে চৌকির অর্ধেকটা পানির নিচে ডুবে থাকছে। আম্পানের রাতে আরও অনেক পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল এ বিদ্যালয় ভবনে। অনেকে চলে গেছে। কিন্তু এ পরিবারগুলোর যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এরা এখানেই রয়ে গেছে। ইসমাইল হোসেন, আবুল বাসার সরদার, নাছির উদ্দিন শেখ, আমিরুন বিবিসহ আরও অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রেই রয়ে গেছেন। ওজিয়ার রহমান শেখসহ আরও যারা এ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন; তারা এখন অন্যত্র অন্যের বাড়িতে অথবা রাস্তার ধারে আশ্রয় নিয়েছেন। ওজিয়ার রহমান জানালেন, বাঁধের ধারে তার যে ঘরখানা ছিল, তা আম্পানের প্রভাবে উড়ে গেছে। জমিজমা কিছুই নেই। শুধু ঘরখানাই ছিল। এখন যে কোথায় বসতি গড়বেন, জানা নেই। অনিশ্চিত জীবন তার।ওজিয়ার রহমান জানালেন, বাঁধের ধারে তার যে ঘরখানা ছিল, তা আম্পানের প্রভাবে উড়ে গেছে। জমিজমা কিছুই নেই। শুধু ঘরখানাই ছিল। এখন যে কোথায় বসতি গড়বেন, জানা নেই। অনিশ্চিত জীবন তার। ইসমাইল হোসেন বলেন, শক্ত বাঁধের দাবিতে এত কান্নাকাটি করি। কেউ ফিরেও তাকায় না। এবার তো সব শেষ হয়ে গেল। এখন কোথায় যাব?
আবুল বাসার বলেন, গোবরা ঘাটাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ডুবন্ত ঘরের ভেতরে একের ওপরে আরেকটি এভাবে তিনটি চৌকি রেখে তার ওপরে রাতে শুধু ঘুমাই। এভাবে ক’দিন চলবে?
গোবরা ঘাটাখালী কপোতাক্ষের নদের তীর ধরে যে বাঁধ, তাকে এখন আর বাঁধ বলার চেয়ে আইল বলাই ভালো। এতটাই সরু এবং ভঙ্গুর যে সামান্য ঢেউ লাগলেই পানি চলে যায় ভেতরে। আর এ স্থান দিয়ে লোকালয়ের ভেতরে পানি প্রবেশের আর প্রয়োজন নেই। কেননা, কপোতাক্ষের বুকে যেভাবে ঢেউ বয়ে চলেছে; ভেতরের অংশেও একইভাবে ঢেউ বইছে। ঘরবাড়ি, উঠোন, ফসলি মাঠ, চিংড়ির ঘের, পানির কল, পুকুর, খেলার মাঠ- সবই ডুবে আছে।
গোবরা ঘাটাখালী বাঁধ যেখানে ধসে গেছে, সেখানেই দেখা হলো আবুল বাসার শেখের সঙ্গে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের রাতে জীবন বাঁচানোর তাগিদে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। দিনের আলো না ফুটতেই ভোরে এসে দেখেন সব শেষ হয়ে গেছে। বাড়ির সামনে থেকেই বাঁধ ধসে যাওয়ায় বাড়ির চারটি ঘরই ভেসে গেছে। পানি কমে যাওয়ার পর বাড়ির আঙিনায় পেয়েছেন কিছু মালামাল আর একটি সাইকেল। সেগুলো গুছিয়ে রেখেছেন ভাঙা বাঁধের ধারে। বাড়িতে থাকা ৩০টি ছাগল, ৫০ মন ধানসহ সব মালামাল ভেসে গেছে। বর্গা চাষি হিসেবে জমিজমা আবাদ করেন বাসার। একখানা নৌকা ছিল, তাতে চলতো নদীর কাজ। এভাবেই টানাটানির সংসার এগিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু আম্পান সব শেষ করে দিয়ে গেল। এখন নিজে বাঁধের ধারে বসে মালামাল পাহাড়া দিচ্ছেন, আর পরিবারের অন্যরা আছেন আশ্রয়কেন্দ্রে।
গোবরা ঘাটাখালীর এ এলাকাটি কয়রা সদর ইউনিয়নের ভেতরে। ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের গোবরা ঘাটাখালী এবং ২ নং ওয়ার্ডের হরিণখোলা গ্রামের কাছে নাজুক বাঁধ ধসে গ্রামের পর গ্রাম ডুবেছে। জীবন যাপনে নিত্যপ্রয়োজনের সব ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে প্রতিবন্ধকতা। গোসল করতে হয় নদীর লোনা পানিতে অথবা কখনো কলের পানিতে। রান্নাবান্নায় সমস্যা দেখা দেওয়ায় তিনবেলা খাবার জোটে না। অনেক বেলা কাটিয়ে দিতে হয় চিড়া-মুড়ি দিয়ে। টয়লেট পানিতে ডুবে থাকায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে অপেক্ষা করতে হয় ভাটার। দীর্ঘদিন পানিতে বসবাসের ফলে লেগেছে অসুখবিসুখ। রাতে ঘুমানোর সমস্যা তীব্র। অনেককে নৌকায়, খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে। অনেকে বাধ্য হচ্ছে গবাদিপশুর পাশে ঘুমাতে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ। এখন লবণ পানির সঙ্গেই এদের ঘরগেরস্থলি।