রবিবার ● ৩ মে ২০২০
প্রথম পাতা » উপকুল » মাঠ পর্যায়ের নেটওয়ার্ক সাংবাদিকতায় এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে দিতে পারে
মাঠ পর্যায়ের নেটওয়ার্ক সাংবাদিকতায় এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে দিতে পারে
রফিকুল ইসলাম মন্টু:
করোনাকাল। ঘরবন্দি মানুষ। সকলেই ঘরবন্দি। আজ ১৬ এপ্রিল থেকে সারাদেশকে সংক্রমন ঝুঁকিপূর্ন দেশ হিসাবে ঘোষণা করল সরকার। আমি সারাক্ষণ ভাবছি উপকূলের মানুষেরা কেমন আছেন। বার বার পোড় খাওয়া, অধিক সংগ্রামে বেঁচে থাকা সেই মানুষগুলোর মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কিন্তু ওদের কাছে গিয়ে খোঁজ নেওয়ার সুযোগ আমার নেই। কেননা আমিও তো ঘরবন্দি। করোনা সংক্রমনের পরিস্থিতিতে ঘরে থাকার সরকারি আদেশের মাত্র দু’দিন আগে ঢাকায় আসি। আর বের হওয়ার সুযোগ হলো না। আসলে বের হয়েও তো লাভ নেই; যেখানে যাবো সেখানেই আবার আটকা পড়ে থাকতে হবে।
এক কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি আমরা। যে শহরে মানুষের কোলাহল; রাস্তায় গায়ে গায়ে লাগানো গাড়ি থাকে; ফুটপাত দিয়ে নির্বিঘে হাঁটার সুযোগ পর্যন্ত নেই। সেই রাজধানী শহর ফাঁকা। এ যেন এক অচেনা শহর। যতই সংকট থাকুক, যতই নিষেধাজ্ঞা থাকুক, জরুরি খাতসমূহের সার্ভিস তো বন্ধ নেই। চিকিৎসকেরা চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এই সময়ে তাদের সেবা সবচেয়ে জরুরি। আছে অন্যান্য পেশার লোকজনের ব্যতিব্যস্ত। সাংবাদিক সমাজেরও ভূমিকা কম নয়। তারা তথ্য দিয়ে সহায়তা করছেন। ঘরবন্দি থাকলে সাংবাদিক কী করে খবর দেবেন পাঠকদের। চলমান ঘটনার বিষয়গুলোর জন্য এই শহরে সাংবাদিকগণ প্রতিনিয়ত ছুটাছুটি করছেন। কিন্তু আমার কাজ তো দৈনন্দিন খবর নয়; বিশেষ খবর। তা আবার উপকূলের। আমার পক্ষে কীভাবে সম্ভব হচ্ছে ঘরবন্দি অবস্থায় প্রতিবেদন লেখা? খুবই যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। জবাবটা এই লেখার শিরোনামেই আছে।
এই বিষয়টি আজ হঠাৎই আমার মাথায় এলো। প্রশ্নটা আমিও আমাকে করেছিলাম; আমি কীভাবে ঢাকায় থেকে উপকূলের মানুষের খবর লিখি। জবাবটাও পেয়ে গেছি খুব সহজেই। সাংবাদিকতায় নেটওয়ার্ক যে বড় ধরণের শক্তি যোগাতে পারে; তারই উদাহরণ কারোনাকালে আমার সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতার ক্লাসে বিভিন্ন সময়ে নেটওয়ার্কিংয়ের কথা বলা হয়। কাজ করতে গিয়ে সাংবাদিকদের একটা নেটওয়ার্ক গড়েও ওঠে। কিন্তু সেটা থাকে একটা লেভেল পর্যন্ত। হয়তো বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে তা সোর্স পর্যায়ে সাংবাদিকেরা নেটওয়ার্ক সংহত রাখে। কিন্তু প্রান্তিক মানুষ পর্যায়ে বা কমিউনিটি পর্যায়ে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে বিরাট সহায়তা পাওয়া যেতে পারে; তারই উহাদরণ সৃষ্টি হয়েছে আমার উপকূল সাংবাদিকতায়। করোনাকাল বলে কথা নয়; যে কোন পরিস্থিতিতে বা কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলেও মাঠ পর্যায়ের নেটওয়ার্ক সাংবাদিকতায় এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে দিতে পারে।
আমি কাজ করছি বাংলাদেশের সমগ্র উপকূল ঘুরে। সমগ্র উপকূল অঞ্চল বলতে আমি বোঝাচ্ছি পূর্বে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে শুরু করে পশ্চিমে শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রাম পর্যন্ত। পুরো এলাকাটি আমার মুখস্থ; করতলের মতই চেনা। কোন এলাকার নাম সামনে এলে ওই এলাকাটিই যেন আমার চোখের সামনে ভাসে। সেখানকার রাস্তাঘাট, বাড়িঘর গুলো যেন আমি দেখতে পাই। সঙ্গে কিছু মানুষের চেহারাও ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মাঠ পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ না রাখলে আমার এই নেটওয়ার্ক গড়ে উঠতো না। ফলে আমার কাজ করা কঠিন হতো। বিপরীতে যোগাযোগ আছে বলে কাজটা সহজ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সহকর্মীদের মধ্যে অনেকে প্রান্তিকের কোন মানুষের সঙ্গে কথা বলার পর আর তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না। কিন্তু আমি যাদের সঙ্গে কথা বলি অধিকাংশ মানুষের মোবাইল নম্বর, ঠিকানা নোটবুটে টুকে রাখি। তখনই মনে করি এই মানুষটি আমার নেটওয়ার্কের একজন সদস্য। দু’বার প্রান্তিকের কোন মানুষকে কল দিলে তারা অন্তত আরও পাঁচবার কল দিবে; এটা নিশ্চিত। আদান প্রদানের ভেতর দিয়ে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে সাংবাদিক হিসাবে আমার দিক থেকে তথ্য পাওয়ার তাগিদ যেমন থাকে; তার চেয়েও নাগরিকগোষ্ঠীর কাছ থেকে তথ্য দেওয়ার তাগিদ আরও বেশি থাকে।
উপকূলের নাগরিকদের কথা মনে করতে গিয়ে আমার খুব মনে পড়ছে ভোলার চরফ্যাসনের ঢালচরের নুরুদ্দিন মাঝির কথা। ঈদের দিনে তার একটা কল আমি পাবোই। গর্বে আমার বুকটা ভরে ওঠে। সেই প্রান্তিক জনপদ থেকে আমার খোঁজ নেয় এই মানুষটি। কুকরি মুকরি কৃষক মোশাররফ হোসেন প্রায়ই কল দিয়ে খোঁজ নেন; কোথায় আছি; কেমন আছি। খুলনার দাকোপের আবদুর রহমান; ট্রলারের মাঝি। নিজের ট্রলার নিজেই চালান। তার ট্রলারে একরাত ঘুমাতে গিয়ে তার সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে। দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে শহরে পড়ে; আরেক ছেলে এলাকার প্রাথমিকে। মাঝে মাঝে আমাকে তিনি খবর দেন। কয়রার বনজীবী মিজানুর রহমান; যিনি এক ভর দুপুরে আমাকে জোর করে বাড়িতে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরিচয় হয়েছিল তার ছেলে নিশানের সঙ্গে; মাধ্যমিকে পড়ছে। স্বপ্ন সেনা অফিসার হওয়ার।আমার খুবই পরিচিত শরণখোলার তাফালবাড়ির ইউসুফ মৃধা; যিনি বর্ষা এলেই নদীর ধারের ঘরটি নিয়ে আতংকে থাকেন। আমার চোখে ভাসে আলেকজান্ডারের হেজুরাম শাহ-এর চেহারা; যে কীনা হঠাৎ আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন- আপনি তো সেদিন কতগুলো ডাকাতের সামনে পড়েছিলেন। ওরা ভালো মানুষ নয়। এড়িয়ে চলে এসেছেন ভালো হয়েছে। আমি ভুলতে পারি না চর আবদুল্লাহর আবুল হোসেন মাঝির কথা। যিনি নিজের নামের সঙ্গে স্ত্রী বিবি সাহিদার নামটি নোটবুকে লিখতে বাধ্য করেছিলেন। চর আবদুল্লাহর আবদুল মতিন; যিনি আমাকে চরে দেখে অবাক হয়ে বলেছিলেন- স্যার আপনি এই চরে? আপনাকে তো সেবার ওই চরে দেখেছি। চলে আসার পরেও মতিন একটা ডিম ভেজে প্লেটে করে দৌড়াতে দৌড়াতে আমার পিছু নেন; আমি এই বয়স্ত মানুষটার কথা ফেলতে পারি না। আমার মনে পড়ে চর আবদুল্লাহর শফিউল্লা, তেলির চরের আলাউদ্দিন মাষ্টার, চম্পা বেগম আর শাহিনুর বেগমদের কথা। আছেন এমন আরও বহুজন। খাতার পাতা ফুরিয়ে যাবে; তবুও নাম ফুরোবে না। এই মানুষগুলো আমাকে খবর দেয়। এরা আমার খবরের ভান্ডার।
উপকূলে আমার খবরের নেটওয়ার্ক পাঁচভাগে বিভক্ত।
১) স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় কর্মরত উপকূলীয় সাংবাদিকদের নেটওয়ার্ক;
২) তৃণমূল পেশাজীবী নাগরিক নেটওয়ার্ক;
৩) নেতৃস্থানীয় নাগরিক সমাজের নেটওয়ার্ক;
৪) কমিউনিটি পর্যায়ের নেটওয়ার্ক;
৫) অফিস পর্যায়ের নেটওয়ার্ক।
বলা যায় এই পাঁচ স্তরের নেটওয়ার্ক আমার উপকূল সাংবাদিকতাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। এবার তাহলে এই পাঁচ স্তরের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে ছোট করে বলি।
উপকূল অঞ্চলে কর্মরত সকল সাংবাদিকেরা যে আমার সঙ্গে সম্পৃক্ত এমনটা নয়। জেলা ও উপজেলা এবং বিভিন্ন বন্দর পর্যায়ের নির্দিষ্ট কিছু সাংবাদিকের সঙ্গে আমার নেটওয়ার্ক রয়েছে। এদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের ফলে সমগ্র উপকূলের সামগ্রিক চিত্র সম্পর্কে আমি আপডেট থাকতে পারি। এরপর আসি তৃণমূল পেশাজীবীদের কথা। আগেই উল্লেখ করলাম, একদম মাঠের পেশাজীবী, যেমন জেলে, কৃষক, ভ্যান চালক, মাছ বিক্রেতা, দুধ বিক্রেতা, ট্রলার চালক, নৌকা চালক, বনজীবী- এই স্তরে রয়েছে আরেকটি নেটওয়ার্ক। এদের সঙ্গে নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদানে জানতে পারি নানান কিছু। এরপর আসি নেতৃস্থানীয় নাগরিক পর্যায়ে। প্রত্যেক এলাকায়ই কিন্তু নেতৃস্থানীয় একটি গ্রুপ থাকে; যারা এলাকার সকল ঘটনায় নেতৃত্ব দেয়। যেমন ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, বিভিন্ন পেশাজীবী সমিতির নেতা ইত্যাদি। এদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে হয়। কমিউনিটি পর্যায়ে রয়েছে আরেকটি নেটওয়ার্ক। উপকূলের বিভিন্ন স্থানে এমন কিছু নির্বাচিত কমিউনিটি রয়েছে। প্রত্যেক স্থানে ৫-৭জন করে লোক আছে। তারা এলাকার বিষয়গুলো নজরে রাখে। গ্রুপে একমত হয়ে তারা বিভিন্ন ধরণের খবর আমাকে দেয়। আরেকটি নেটওয়ার্ক স্তর রয়েছে অফিস পর্যায়ে। যেমন স্থানীয় সরকারি অফিস, এনজিও অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ অফিস ইত্যাদি।
এবার এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যদি তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাই, তাহলে কিন্তু চমৎকার এক সমন্বয় হয়ে যায়। আমি সেটাই করছি। অনেকেই আমার সঙ্গে সামাজিক মিডিয়ায় সম্পৃক্ত রয়েছেন। যাদের সে সুযোগ নেই, তাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করি মোবাইলে। এভাবে শুধু বক্তব্য নয়, বা মানুষের কথা নয়, অনেক সময় আলোকচিত্র কিংবা ভিডিও পর্যন্ত আমার নেটওয়ার্ক আমাকে পাঠায়। আলোচনায় আমি এটাই বোঝাতে চাই, একজন সাংবাদিকের কাজকে এগিয়ে নিতে নেটওয়ার্ক খুবই গুরুত্বপূর্ন। যে সাংবাদিক যে ফিল্ডে কাজ করেন; তার সেই ফিল্ডের একেবারে মাঠ লেভেল পর্যন্ত নেটওয়ার্ক থাকা খুবই জরুরি। তাহলে করোনার মত জরুরি সময়েও আমরা অন্তত একেবারে আটকে থাকবো না।